আপনি কি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন?

আপনি হয়তো ভাবছেন, আমার বংশে তো কারো ডায়াবেটিস নেই, তাহলে হয়তো আমার ডায়াবেটিস হবার কোনো ঝুঁকি নেই। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীটা এমন যে, কেউই এই ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে পারেন না। ডায়াবেটিসের রোগপূর্ব ঝুঁকিগুলোকে প্রধানত দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। কিছু আছে নন মডিফায়েবল ফ্যাক্টর, অর্থাৎ যেগুলো চাইলেই আমরা নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন করতে পারি না। যেমন বংশগতির প্রভাব, পারিবারিক ডায়াবেটিসের ইতিহাস বা বয়স। আর কিছু ফ্যাক্টরে আমরা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যেমন, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রমের প্রতি অনীহা কিংবা অতিরিক্ত ওজন।

আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার পেছনে বংশগতির একটা বড় ভূমিকা আছে। যাঁদের পরিবারের রক্ত সম্পর্কীয় সদস্যদের মধ্য ডায়াবেটিস থাকে, তাঁদের এ রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে তার মানে এই নয় যে, আপনার বাবা মার ডায়াবেটিস থাকলে আপনারও ডায়াবেটিস হবে। বরং এক্ষেত্রে বংশগতি ও পরিবেশ বা জীবনযাত্রার প্রভাব মিলিতভাবে কাজ করে। যদি আপনার বংশে ডায়াবেটিস থাকে এবং আপনি ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হন, যেমন, অতিরিক্ত চিনি ও উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করা, অতিরিক্ত ওজনের বিষয়ে সচেতন না হওয়া, তবেই কেবল আপনার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে স্থূলতার কথা। বর্তমান কালের যান্ত্রিক পৃথিবীতে স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন খুবই সাধারণ সমস্যা। ১৯৭৫ সালের পর বিগত ৪০ বছরে পৃথিবীতে অতিরিক্ত ওজনের মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনু্যায়ী বিশ্বে প্রায় ১৯০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ওজনের, যাদের মধ্যে প্রায় ৬৫ কোটি মানুষ স্থূলতায় আক্রান্ত।

এখানে বলে রাখা ভালো, নাদুস নুদুস চেহারা মানেই কিন্তু স্থূলতা নয়, স্থূলতা মাপার জন্যে নির্দিষ্ট স্কেল রয়েছে, সেটি হচ্ছে বডি মাস ইনডেক্স বা BMI। আপনার উচ্চতাকে মিটারে প্রকাশ করে তার বর্গ দিয়ে আপনার ওজনকে ভাগ করলে যে অনুপাত পাওয়া যাবে, সেটাই আপনার বডি মাস ইনডেক্স। একজন সাধারণ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের BMI স্বাভাবিকভাবে ১৮.৫ থেকে ২৪.৯ কেজি প্রতি বর্গ মিটারের মধ্যে থাকা উচিৎ। BMI যদি ২৫ এর বেশি হয়, তাহলে তাকে বলা হয় অতিরিক্ত ওজন, আর যদি ৩০ বা তার বেশি হয়, তাহলে তাকে বলা হবে স্থূলতা।

BMI যদি ১৮.৫ এর নিচে থাকে, তাহলে ঐ ব্যক্তির ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম বলে বিবেচনা করা হয়। তবে মজার বিষয় হলো, পৃথিবীতে কম ওজনের কারণে যতো মানুষ মারা যান, তার তুলনায় অনেক বেশি মানুষ মারা যান অতিরিক্ত ওজনের কারণে। কেবল পূর্ণবয়স্ক মানুষই নন, বর্তমানে শিশু কিশোররাও অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতায় আক্রান্ত। বিশ্বের ৫ বছর বয়সের নিচের শিশুদের প্রায় ১৮% অতিরিক্ত ওজনের, ১৯৭৫ সালে যা ছিল মাত্র ৪%। এছাড়া ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রায় ৩৪ কোটি শিশু কিশোর স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজনের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। স্থূলতার অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধান হচ্ছে খাদ্য গ্রহণ ও শারীরিক পরিশ্রমের ভারসাম্যহীনতা।

বিগত বছরগুলোতে আমাদের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও তার ছোঁয়া লেগেছে। সাধারণ মাছ ভাতের মায়া ভুলে আমরা ঝুঁকছি ফাস্টফুড, প্রসেসড ফুড, কোল্ড ড্রিংকসহ নানা ধরণের উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্যের দিকে। সেই সাথে অতিরিক্ত নগরায়ণ, যান্ত্রিক যানবাহন ও অন্যান্য সুবিধা কমিয়ে দিয়েছে মানুষের শারীরিক শ্রমের মাত্রা। ফলে দিন দিন আরো বেশি মানুষ মুটিয়ে যাচ্ছেন, তৈরি হচ্ছে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগের মতো নানা জটিল সমস্যা। সত্যি বলতে বাংলাদেশের অবস্থা যেন শাঁখের করাতের মতো। একদিকে গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষ এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে, অন্যদিকে শহরাঞ্চলে দেখা দিচ্ছে অতিরিক্ত স্থূলতা। এই দ্বিমুখী স্বাস্থ্য ঝুঁকি সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। উচ্চক্যালরিযুক্ত খাদ্য কেবল আমাদের ওজনই বাড়িয়ে দিচ্ছে না, সেই সাথে বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের রক্তের চর্বির মাত্রা। এর সাথেও ডায়াবেটিসের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।

আমরা যেসব চর্বিজাতীয় খাবার খাই, যেমন গরু বা খাইর মাংস, ঘি, মাখন, সেগুলো ছাড়াও আমাদের খাদ্যের অতিরিক্ত চিনি দেহের ভেতরে চর্বিরূপে জমা হয়। আমাদের রক্তে মূলত দু ধরণের চর্বি থাকে; একটি হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (HDL) বা ‘গুড কোলেস্টেরল’, যেটি স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো, অন্যটি লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (LDL) বা ‘ব্যাড কোলেস্টেরল’, যেটি ক্ষতিকর। যদি রক্তে HDL এর মাত্রা কমে যায় এবং LDL এর মাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে সে অবস্থাকে বলে ডিজলিপিডেমিয়া, যা কিনা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আগেই বলা হয়েছে, ইনসুলিন দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কোষের নির্দিষ্ট অংশ বা রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে রক্তের গ্লুকোজকে কোষের ভেতর ঢুকতে সাহায্য করে। কিন্তু রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে গেলে ইনসুলিনের কোষের রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হবার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে গ্লুকোজ কোষে না ঢুকে রক্তেই থেকে যায় ও রক্তে দীর্ঘস্থায়ীভাবে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

ইম্পেয়ার্ড গ্লুকোজ টলারেন্স বা ত্রুটিপূর্ণ শর্করার বিপাকের বিষয়ে আগেই বলা হয়েছে। এটা এমন একটা পর্যায়, যাতে রক্তের গ্লুকোজ ঠিকমতো বিপাক ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে পারেনা। ফলে খাদ্য গ্রহণের পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়। এ ধরণের রোগীদের পরবর্তী জীবনে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় এক ধরণের ডায়াবেটিস দেখা যায়, যাকে বলে ‘জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাস’ বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তান জন্ম দানের পর এটি ভালো হয়ে যায়। তবে ঠিকমতো চিকিৎসা না করালে অনেক সময় এটি স্থায়ী রূপ লাভ করে ও ডায়াবেটিসে পরিণত হয়।

আরো অনেক শারীরিক অসুখের কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে। অগ্ন্যাশয়, যা কিনা ইনসুলিন হরমোনের উৎস, তার কোনো অসুখ সরাসরি ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। ফলে ডায়াবেটিস দেখা দেয়। অন্য যে কোনো ধরণের হরমোন, যার সাথে রক্তের শর্করা বিপাকের সম্পর্ক আছে, সেগুলোর মাত্রায় কোনো কমবেশি হলেও ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে অনেকগুলো বিষয় কাজ করলেও আশার কথা হলো এগুলোর বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এজন্যে প্রয়োজন ব্যক্তিগত সদিচ্ছার। আপনি চাইলেই হয়ে উঠতে পারেন আপনার স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রক, কমিয়ে ফেলতে পারেন আপনার ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা। সেজন্যে কী কী করতে হবে, তার টিপস থাকছে পরবর্তী পর্বে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart