ডায়াবেটিস পুরো পৃথিবীর মাথা ব্যথা!!

বর্তমানে মানবজাতির জন্য যে কয়টি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, ডায়াবেটিস তার মধ্যে অন্যতম। উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে আফ্রিকা বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ, সবাইকেই এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

সময় যতো গড়াচ্ছে, এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ততো বাড়ছে। এই ফাঁকে বলে রাখি, ডায়াবেটিস কিন্তু মোটেও নতুন কোনো রোগ নয়। এ রোগের প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের মিশরীয় সভ্যতায়। তারা একে ‘অতিরিক্ত মূত্রপাত’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। সে সময় ধারণা করা হতো, ডায়াবেটিস হলো অতিরিক্ত মূত্রপাত জনিত কোনো রোগ। প্রায় সমসাময়িক কালে ভারতীয় চিকিৎসকরা খেয়াল করলেন, এ ধরণের রোগীদের মূত্রের প্রতি পিঁপড়াদের আকর্ষণ বেশি থাকে। সেজন্যে তাঁরা এ রোগের নাম দিলেন ‘মধুমেহ’ বা মধুযুক্ত মূত্র। ‘ডায়াবেটিস মেলাইটাস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন গ্রীক চিকিৎসাবিদ এপোলোনিয়াস। ডায়াবেটিস শব্দের অর্থ ‘কোনো কিছুর মধ্য দিয়ে বের হওয়া’ আর মেলাইটাস অর্থ মিষ্টি।

গ্রিক চিকিৎসক এরেটিয়াস প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত সফল হতে পারেন নি। এছাড়া মধ্যযুগের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা এ রোগের বিস্তারিত বর্ণনা দেন এবং কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। প্রাচীন রোমান সভ্যতায় একে বিরল রোগ হিসেবে বর্ণনা করা হতো। সে যুগের মানুষদের পরিশ্রমী জীবনযাপন ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এর পেছনের অন্যতম কারণ হতে পারে। সে যাই হোক, আমরা বর্তমানে ফিরে আসি। বর্তমান পৃথিবীতে এ রোগটি আর মোটেও বিরল নয়। বরং প্রাচীনকালের গুটিবসন্ত, কলেরা বা প্লেগ মহামারীর মতো এখনকার দিনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বছরের রিপোর্ট অনু্যায়ী বর্তমান পৃথিবীতে ৪২২ মিলিয়ন বা ৪২ কোটির বেশি মানুষ ডায়াবেটিস মেলাইটাসে আক্রান্ত, অথচ ১৯৮০ সালে যে সংখ্যাটা ছিল মাত্র ১০৮ মিলিয়ন। অর্থাৎ, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার সাড়ে আট শতাংশ এ রোগে আক্রান্ত। ২০১৬ সালে পৃথিবীর প্রায় ১৬ লাখ মানুষ মারা গিয়েছেন সরাসরি ডায়াবেটিসের কারণে।

আরো ২২ লাখ মানুষ মারা গিয়েছেন এ রোগের নানাবিধ জটিলতায় ভুগে। আর এ মৃত্যুর প্রায় সবগুলোই ঘটেছে ৭০ বছর বয়সের মধ্যে। বর্তমানে ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর সপ্তম প্রধান কারণ। একটা সময় ধারণা করা হতো ডায়াবেটিস কেবল সমাজের উঁচুতলার মানুষের অসুখ। কিন্তু গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার নিম্ন বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোতে। যেখানে উন্নত বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার গড় বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি, সেখানে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সেটি মাত্র ৪৫ থেকে ৬৪ বছর। তার মানে, এ রোগটি এসব দেশের কর্মক্ষম মানুষের একটি বড় আংশকে আক্রান্ত করছে, তাঁদের কর্ম ক্ষমতা নষ্ট করছে। ফলে দেশের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, যা কিনা একটা দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের পথে বড় বাঁধা।

বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের রিপোর্ট অনু্যায়ী এদেশের প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এঁদের অর্ধেকের বেশি মানুষ জানেনই না যে তাঁদের ডায়াবেটিস আছে। এছাড়াও প্রিডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে আছেন আরো প্রায় ৩৬ লক্ষ মানুষ। সংখ্যাটা কিন্তু মোটেও কম নয়। তবে সামনে আরো ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, আগামী ২০৪৫ সালে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হবে প্রায় দেড় কোটি এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকবেন আরো প্রায় ৬৮ লক্ষ মানুষ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করেন, যাদের অর্ধেকের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় তাঁদের বয়স ৬০ বছর হবার পূর্বেই।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের এই ঊর্ধমুখী হারের পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে আমাদের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও। শহরাঞ্চলের বহু মানুষ দিন দিন উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ফাস্টফুড, কোল্ড ড্রিংক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ইত্যাদির প্রতি ঝুঁকছে। এসব খাবারের অতিরিক্ত চিনি ও চর্বি বাড়িয়ে দিচ্ছে স্থূলতার ঝুঁকি। সেই সাথে কমে গেছে শারীরিক পরিশ্রম করার প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা। সব মিলিয়ে বাড়ছে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। কেবল স্বাস্থ্যগত ক্ষতিই নয়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ডায়াবেটিস বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। আগে সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পরে ডায়াবেটিস হলেও ইদানিং অনেক কম বয়সে ডায়াবেটিস হবার মাত্রা বাড়ছে।

উৎপাদন ক্ষমতার শীর্ষে থাকা এসব মানুষের রোগাক্রান্ত হবার ফলে তাদের কর্মক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের জিডিপিতে। এছাড়া ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসার পেছনে পরিবারকে একটা বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা কিনা দেশের দরিদ্র বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর পক্ষে বেশ কষ্ট সাধ্য। বাংলাদেশে প্রতিজন ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসার পেছনে বছরে প্রায় ৫১ মার্কিন ডলার করে ব্যয় করতে হয়, অর্থাৎ সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৩৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০৪৫ সালে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৫৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতিকে ব্যাপকভাবে বাঁধাগ্রস্ত করবে। তাই ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এখনই সময়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart