ডায়াবেটিস রোগীরা কি মধু খেতে পারবেন?

মধু প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। সেই আদিকাল থেকে মানুষ রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে মধুর ব্যবহার করে আসছে। কেবল সুস্বাস্থ্যের উপকরণ হিসেবেই নয়, মধুর রয়েছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব। ইসলাম ধর্মমতে, ‘মৌমাছির পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানি নির্গত হয়, যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার।’ তাছাড়া প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রে মধুর ওষুধি ও আধ্যাত্মিক গুণের উল্লেখ আছে। প্রাকৃতিক মধুর নানা গুণ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। অনেকেই চিনি বা অন্যান্য মিষ্টিকারক দ্রব্যের বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক মধু ব্যবহার করে থাকেন।

এখন প্রশ্ন হতে পারে ডায়াবেটিস রোগীরা, যাঁদের রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি, তাঁরা মধু খেতে পারবেন কিনা। এর উত্তরটা একেবারে সরল করে দেয়া কঠিন। এজন্যে আমাদের প্রথমেই মধুর গঠন ও খাদ্যমান সম্পর্কে জানতে হবে। মৌমাছি ফুল থেকে নির্যাস না নেকটার সংগ্রহ করার পর তার দেহের নানা উৎসেচকের প্রভাবে প্রক্রিয়াজাত করে। তারপর সেটি মৌচাকে জমা রাখে মধু হিসেবে। মধুতে সাধারণত পানির পরিমাণ অনেক কম থাকে, মাত্র ১৭ শতাংশ। ফলে মধু সহজে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে নষ্ট হয় না। মধুর মূল উপাদান সুক্রোজ, যা গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজের সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিল শর্করা।

এছাড়া এতে সামান্য প্রোটিন, খনিজ লবণ, ভিটামিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম খাঁটি প্রাকৃতিক মধুর খাদ্যমান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে প্রায় ৮২ গ্রাম সুক্রোজ বা চিনি থাকে, যার খাদ্যমান প্রায় ৩০০ কিলোক্যালোরি। এছাড়া এতে থাকে ৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ৪ মিলিগ্রাম ফসফেট, আয়রন ও অন্যান্য খনিজ লবণ। মধুতে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন ভিটামিন থাকে, যেগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। মধু ও সাধারণ চিনি দুয়েরই মূল উপকরণ সুক্রোজ। সুক্রোজ ভেঙে দেহে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ তৈরি হয়।

মধু ও চিনি উভয়ের গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের পার্থক্য বেশি নয়, মধুর ৫৮, চিনির ৬০, অর্থাৎ উভয়ই দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়। এদিক থেকে অবশ্য গুড় সামান্য এগিয়ে আছে, এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫৫। প্রতি ১০০ গ্রাম মধুতে সুক্রোজের পরিমাণ প্রায় ৮২ গ্রাম, যেখানে পরিশোধিত চিনির পুরোটাই সুক্রোজ। মধুতে চিনির তুলনায় ফ্রুকটোজের পরিমাণ বেশি বলে এর মিষ্টতা বেশি। ফলে অল্প মধুতেই কাজ হয়। তবে মধু চিনির তুলনায় অনেক ঘন ও ভারি। এক টেবিল চামচ মধুতে থাকে প্রায় ১৭ গ্রাম শর্করা, যার খাদ্যমান প্রায় ৬৪ কিলোক্যালোরি, যেখানে এক টেবিল চামচ বা ১২ গ্রাম চিনির খাদ্যমান ৪৯ কিলোক্যালোরি।

ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর মধুর প্রভাব নিয়ে গবেষণার ফলাফল দ্বিধাবিভক্ত। কিছু গবেষণায় দেখা যায় মধু সাধারণ চিনির তুলনায় দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়। সেই সাথে ইনসুলিন ক্ষরণের মাত্রাও বাড়ায়। ফলে দ্রুত সেই গ্লুকোজ আবার কমেও যায়। সেই সাথে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়াতেও মধুর উপকারিতা আছে। ৩২ জন ডায়াবেটিস রোগীর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায় ২ টেবিল চামচ মধু ও ১ কাপ বা ১২৫ গ্রাম সাদা ভাত খাবার পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধির হার প্রায় সমান। তবে দীর্ঘস্থায়ী গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে মধুর খুব বেশি উপকারিতা নেই। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায় ২ মাস মধু ব্যবহারের পর রক্তের HbA1c এর পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে মিষ্টিকারক ছাড়াও মধুর অন্য অনেক ওষুধি গুণ আছে। মধুর গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন রকম এন্টি অক্সিডেন্ট।

আমাদের দেহে বিপাক ক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন জারক যৌগ বা ফ্রি রেডিক্যাল তৈরি হয়, যেগুলো দেহকোষের বিভিন্ন উপাদানের সাথে বিক্রিয়া করে কোষের ধ্বংস ত্বরান্বিত করে। বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও প্রদাহের পেছনে এসব যৌগের ভূমিকা আছে। দেহকোষের অনিয়ন্ত্রিত ধ্বংস বা বৃদ্ধি ও কিছু ক্যান্সার সৃষ্টিতেও এসব যৌগ অনেকাংশেই দায়ী। এন্টি অক্সিডেন্ট এসব ক্ষতিকর যৌগের সাথে যুক্ত হয়ে এগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, ফলে দেহ এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়। আর এসব এন্টি অক্সিডেন্টের একটা ভালো উৎস হলো প্রাকৃতিক খাঁটি মধু। এতে বিভিন্ন জৈব এসিড ও ফেনলের মতো প্রয়োজনীয় এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে। এছাড়া গবেষণায় দেখা যায়, মধু রক্তে থাকা বিভিন্ন এন্টি অক্সিডেন্টের কার্যকারিতাও অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।

ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এ বিষয়টি তো সর্বজন স্বীকৃত, যার প্রমাণ পাওয়া যায় আমাদের লোকজ চিকিৎসায় সাধারণ সর্দি কাশি বা গলা ব্যথায় মধুর নৈমিত্তিক ব্যবহারে। মধু একটা ভালো প্রাকৃতিক এন্টিসেপ্টিক, কেননা এতে থাকে হাইড্রোজেন পারক্সাইড, যা জীবাণু ধ্বংস করে। এছাড়া একে এন্টিবায়োটিক ও এন্টিফাংগাল ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের জন্যেও গবেষণা চলছে। দ্রুত ক্ষত সারাতে মধুর ভূমিকা অনন্য, মূলত মানুকা মধু নামে বিশেষ এক প্রজাতির মধু এক্ষত্রে বেশি উপযোগী। এর বিভিন্ন উপাদান ক্ষতস্থানে সংক্রমণের হার কমায় ও দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে। এমনকি হাসপাতালেও ক্ষত নিরোধক হিসেবে মধু ব্যবহারের চেষ্টা চলছে, তবে সেটি নিশ্চয় বাজার থেকে কেনা সাধারণ মধু নয়, বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করা মধু।

মধুর এসব ওষুধি গুণের কথা বিবেচনা করলে মধু অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো। বিশেষ করে চিনি, সিরাপ বা অন্যান্য কৃত্রিম মিষ্টিদ্রব্যের তুলনায় মন্দ নয় মোটেই। তিবে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে তা খেতে হবে বুঝেশুনে। যদি আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, যদি আপনি নিয়মিত ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করেন তাহলে সামান্য পরিমাণ মধু প্রতিদিন খাওয়াই যায়, সেটি হতে পারে এক টেবিল চামচ পরিমাণ। তবে সেক্ষত্রে অবশ্যই অন্যান্য চিনি বা মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য বাদ দিতে হবে। আপনার চিকিৎসক বা ডায়েটিশিয়ানের নিত্যদিনের রুটিনের সাথে মিল রেখে সেটি ব্যালান্স করা উচিৎ। সবচেয়ে ভালো হয়, বুষয়টি নিয়ে আপনার চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করলে, কেননা, তিনিই আপনাকে আপনার রোগের অবস্থা বুঝে সর্বোত্তম পরামর্শ দিতে পারবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart