নিয়মিত চেক আপ: কী ও কেন?

আমরা সবাই জানি, ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য অসুখ নয়। বরং পরিশীলিত জীবন যাপন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবনের মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাধারণত সুশৃঙ্খল জীবনাচরণ, পরিমিত খাদ্যাভ্যাস ও প্রয়োজনে মুখে খাবার ওষুধ বা ইনসুলিনের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। এগুলোর কোনোটিই সব সময়ের জন্য একই রকম নয়।

ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা, শারীরিক অবস্থা ও অন্যান্য অসুস্থতার ভিত্তিতে প্রায়ই এগুলোর পরিমার্জন দরকার হয়। আর প্রতিটি রোগীর চিকিৎসার ধরণ আলাদা। এজন্যে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরী। কতোদিন পরপর ডাক্তার দেখানো উচিৎ সে বিষয়ে আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনের নির্দেশনা হলো যেসব রোগী ইনসুলিন ব্যবহার করছেন, তাঁরা প্রতি তিনমাস অন্তর ও যেসব রোগী মুখে খাবার ওষুধ ব্যবহার করছেন, তাঁরা প্রতি ছয় মাস অন্তর চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। তবে ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে আরো ঘন ঘন ডাক্তার দেখানো দরকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসক আপনার রোগের অবস্থার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন।

যদি কোনো রোগীর ডায়াবেটিস জনিত কিংবা অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। প্রতিবার ভিজিটের সময় চিকিৎসক কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন। এর মধ্যে আছে ওজন মাপা, রক্তচাপ মাপা ও র‍্যান্ডম ব্লাড সুগার। তাছাড়া প্রতি তিন মাসে একবার HbA1c পরীক্ষা করতে হবে। এতে গত তিন মাসে রক্তের গ্লুকোজ কতোটুকু নিয়ন্ত্রণে ছিল তা বোঝা যাবে। সাধারণত এর মান ৬ শতাংশের নিচে থাকা ভালো। ডায়াবেটিস এমন একটা রোগ যার ফলে শরীরের প্রায় সব বিপাকীয় কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যদি ডায়াবেটিস দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে তা শরীরে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করে। তাই এ বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া উচিৎ। এ ধরণের রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের পাশাপাশি কোলেস্টেরল ও অন্যান্য চর্বির মাত্রাও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। ফলে Atherosclerosis বা রক্তনালী ব্লক হয়ে যাবার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এতে হার্ট এটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বছরে অন্তত একবার রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিৎ ও প্রয়োজনে সে অনু্যায়ী চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ সেবন করা উচিৎ। তাছাড়া রক্তের দীর্ঘস্থায়ী অতিরিক্ত শর্করা কিডনির কাজকে বাঁধাগ্রস্ত করে।

কিডনি ডেমেজের লক্ষণ হিসেবে প্রস্রাবে প্রোটিন দেখা দিতে পারে বা রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই নিয়মিত রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে দেখতে হবে কিডনির কোনো সমস্যা আছে কিনা। ডায়াবেটিস রোগীদের দুটো ঝুঁকিপূর্ণ অঙ্গের একটা হলো চোখ, অন্যটা পা। চোখের রক্ত নালীতে অতিরিক্ত গ্লুকোজের উপস্থিতি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির জন্যে দায়ী। সময়মতো এর চিকিৎসা না করলে পরবর্তীতে চোখের বড় ক্ষতি হবার আশংকা থাকে। তাই বছরে অন্তত একবার চোখের ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস থাকলে হাত পায়ের চামড়ার নিচের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি নামক জটিলতার সৃষ্টি হয়। ফলে অনেক ডায়াবেটিস রোগীর হাত পা জ্বালাপোড়ার অভিজ্ঞতা হয়। এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।

তাছাড়া স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হবার ফলে অনুভূতি সঞ্চালন বাঁধাপ্রাপ্ত হয়, বিশেষ করে পায়ে এই সমস্যা বেশি হয়। ফলে অনেক সময় দেখা যায় পায়ে কোনো ব্যাথা পেলে বা ক্ষত হলে রোগীরা টের পান না। আর যেহেতু রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজের উপস্থিতির কারণে ক্ষত শুকাতে দেরি হয়, তাই ‘ডায়াবেটিক ফুট’ হতে পারে। এক্ষেত্রে পায়ে বড় ধরণের ক্ষত তৈরি হয় এবং অনেক সময় পায়ের আঙ্গুল বা পুরো পা-ই কেটে ফেলা লাগতে পারে। তাই পায়ের প্রতি নজর দিতে হবে। প্রতিবার ভিজিটের সময় যেন অবশ্যই পা পরীক্ষা করে দেখা হয়। তাছাড়া নিজেও নিয়মিত পা পরীক্ষা করতে হবে। পায়ের কোনো ক্ষত, চামড়ায় কোনো পরিবর্তন, জ্বালাপোড়া অবশ্যই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। ডাক্তারের চেম্বারে কী বলা উচিৎ সেটা নিয়ে অনেকেই কনফিউশনে থাকেন। অনেকেই প্রয়োজনীয় কথা বলতে ভুলে যান। সেক্ষেত্রে আপনি সমস্যাগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে নিতে পারেন।

তবে খেয়াল রাখা উচিৎ তালিকা যেন প্রাসঙ্গিক ও সংক্ষিপ্ত হয়, কেননা আমাদের দেশে রোগীর চাপ অনেক বেশি। ফলে কনসাল্টেশনের খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না। আপনার টেস্টের রিপোর্ট ও আগের সকল প্রেসক্রিপশন সাথে রাখুন। আগের চেক আপ থেকে এই চেক আপ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যদি কোনো নতুন ওষুধ খেয়ে থাকেন, কোনো ওষুধ বাদ দিয়ে থাকেন বা ডোজ কমবেশি করে থাকেন, সেটা অবশ্যই চিকিৎসককে জানান। আপনি কোনো হারবাল, হোমিওপ্যাথি বা অন্য কোনো ওষুধ গ্রহণ করে থাকলে সেটাও জানান। এর মধ্যে আপনার কোনো শারীরিক সমস্যা হয়েছিল কিনা বা ডায়াবেটিস ওঠানামা করেছিল কিনা সে সম্পর্কে বলুন।

আরেকটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদিও আমাদের দেশে তার খুব একটা চল নেই। সেটা হলো অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত। কতোটা দামি ওষুধ আপনি গ্রহণ করতে পারবেন, দিনের কোন সময় ওষুধ খাওয়া আপনার জন্য সুবিধাজনক, কেমন ডায়েট প্ল্যান বা ব্যায়াম আপনার দৈনন্দিন জীবনের সাথে মানানসই, এসব চিকিৎসককে জানান। এতে করে তিনি আপনার সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সেবা দিতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনার চিকিৎসকই আপনার বন্ধু ও মেন্টর। প্রাসঙ্গিক সকল সমস্যা নিয়ে তাঁর সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন। নিয়মিত চেক আপ ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবনের মাধ্যমেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই কবে অসুখ হবে, সেদিকে চেয়ে না থেকে নিয়মিত রুটিন চেক আপে অংশ গ্রহণ করুন। এতে করে ডায়াবেটিস জনিত অনেক জটিলতা শুরুর আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart