রকমারি ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরণের হয়ে থাকে : ডায়াবেটিস মেলাইটাস ও ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস। আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ডায়াবেটিস মেলাইটাস। আগেই বলা হয়েছে যে রক্তে গ্লুকোজ বা চিনির মাত্রা বেশি হলে তাকে ডায়াবেটিস মেলাইটাস বলে। রক্তে এই চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ‘ইনসুলিন’ নামক একটি হরমোন। কোনো কারণে এই ইনসুলিনের ক্ষরণ কমে গেলে বা ইনসুলিন তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যায় ও ডায়াবেটিস হয়।

ইনসুলিনের এই কার্যকারিতার ভিত্তিতে ডায়াবেটিস মেলাইটাসকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। টাইপ ১ ডায়াবেটিস মেলাইটাস ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস মেলাইটাস। প্রথমেই আসি টাইপ ১ ডায়াবেটিস। এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিনের ক্ষরণ কমে যায়। এটি কীভাবে কমে যায়, তার পেছনে অনেকগুলো মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতবাদ হলো ‘অটো ইমিউনিটি’ মতবাদ।

আমরা সবাই হয়তো জানি, আমাদের রক্তে কিছু কোষ থাকে, যেগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। এই কোষগুলো এন্টিবডি নামক একধরণের প্রোটিন তৈরি করে, যা দেহের বাইরে থেকে আগত শত্রু যেমন, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের শরীর এমন কিছু এন্টিবডি তৈরি করে, যা কিনা আমাদের শরীরের কোনো অঙ্গের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে, অনেকটা যে ডালে বসে আছি, সে ডালই কেটে ফেলার মতো আরকি। সেগুলো আমাদের শরীরের কোনো কোষ বা উপাদানের বিরুদ্ধে কাজ করে তাকে ধ্বংস করে ফেলে।

এ ধরণের এন্টিবডিকে বলে ‘অটো এন্টিবডি’। ঠিক এই ঘটনাই ঘটে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে। আমাদের অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ, যেখান থেকে ইনসুলিন ক্ষরণ হয়, তার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়। সেগুলো বিটা কোষকে ধ্বংস করে ফেলে। বিটা কোষ ধ্বংস হলে অগ্ন্যাশয় আর ইনসুলিন তৈরিই করতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়াও টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বংশগতির একটা বড় ভূমিকা আছে। যাদের বাবা মা বা রক্ত সম্পর্কের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কারো এ রোগ থাকে, তাদের এতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অনেকাংশেই বেড়ে যায়। তবে স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন এ রোগের পেছনে দায়ী নয়। বরং এসব রোগীদের একটা বড় অংশই কম ওজন ও স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগেন। কিছু কিছু ভাইরাসের সংক্রমণও এর পেছনে দায়ী থাকতে পারে বলে মনে করা হয়।

আবার পৃথিবীর নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল যেমন ফিনল্যান্ড ও সুইডেনে এর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বিটা কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়া সাধারণত জন্মের পরপরই শুরু হয়। ফলে শিশু বয়সেই অগ্ন্যাশয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ডায়াবেটিসের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেহেতু এই ডায়াবেটিস সাধারণত ২০ বছর বয়সের আগেই ধরা পড়ে, তাই একে ‘জুভেনাইল ডায়াবেটিস’ বা শৈশবকালীন ডায়াবেটিসও বলা হয়ে থাকে। এ ধরণের রোগীদের রক্তের ইনসুলিন পরিমাপ করলে দেখা যায় তা একদমই শূন্যের কোঠায়। তাই এ রোগীদের একমাত্র চিকিৎসা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ইনসুলিন ব্যবহার করা।

অন্যান্য ওষুধ, যেগুলো অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিনের ক্ষরণ বাড়ায়, সেগুলো এক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসবে না। তবে কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো ইনসুলিনের ক্ষরণ বাড়ায় না, তবে ইনসুলিনের প্রতি কোষের আকর্ষণ বাড়িয়ে তার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। এবারে টাইপ ২ ডায়াবেটিস মেলাইটাস। ডায়াবেটিস বলতে আমরা সাধারণত একেই বুঝে থাকি। পৃথিবীতে যতো মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তার নব্বই শতাংশই টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ শুরুতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়না। ফলে ইনসুলিন উৎপাদনে কোনো ঘাটতি হয় না। এখানে যা হয়, সেটা হলো ইনসুলিন কোষের যে অংশের সাথে যুক্ত হয়ে গ্লুকোজকে কোষের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করে, যাকে বলা হয় ‘রিসেপ্টর’, তার সাথে ইনসুলিনের যুক্ত হবার ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ, এধরণের রোগীদের রক্তে যথেষ্ট পরিমান ইনসুলিন থাকে, কিন্তু সেগুলো কাজ করতে পারে না। কোষের রিসেপ্টরগুলো যেন ঐ ইনসুলিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইনসুলিনের এরকম কাজ করার অক্ষমতাকে বলা হয় ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’।

অগ্ন্যাশয় যখন বুঝতে পারে, ইনসুলিন দেহে কাজ করতে পারছে না, তখন সে আরো বেশি বেশি করে ইনসুলিন তৈরি করতে থাকে, যা দিয়ে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের প্রাথমিক ধাক্কার অনেকটাই সামাল দেয়া যায়। ফলে ক্ষেত্র বিশেষে এ ধরণের রোগীদের রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিও পাওয়া যেতে পারে। এভাবে সামর্থ্যের চেয়ে বেশি কাজ করতে করতে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো একসময় তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে এবং ধ্বংস হয়ে যায়। রোগের এই পর্যায়ে এসে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা কমতে শুরু করে। এসময় ডায়াবেটিসের বিভিন্ন লক্ষণ জটিল আকার ধারণ করে।

টাইপ ২ ডায়াবেটিসের অনেকগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর বা রোগপূর্ব ঝুঁকি রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ও শারীরিক কর্মহীনতা। এছাড়া অনেকক্ষেত্রে বংশগতিও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। যাদের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে এ রোগ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেকাংশেই বেড়ে যায়। তাছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার প্রবণতাও বেড়ে যায়। যদিও ইদানিং অনেক কম বয়সেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার নজির কম নয়। আরো এক ধরণের ডায়াবেটিস আছে, জেস্টেশনাল বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। গর্ভাবস্থায় নারীদের দেহে নানা ধরণের পরিবর্তন হয়। এ সময় ইস্ট্রোজেন নামের একটা হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়।

ধারণা করা হয়, এই ইস্ট্রোজেন গ্লুকোজের বিপাক ক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত করে। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস দেখা দেয়। সাধারণত সন্তান জন্মদানের পর এ ধরণের ডায়াবেটিস ভালো হয়ে যায়। তবে নিয়মিত চিকিৎসা না করলে তা স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে। আর ভালো হয়ে গেলেও এ ধরণের রোগীদের পরবর্তী জীবনে ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কারণও একই রকম: অতিরিক্ত ওজন, শারীরিক পরিশ্রম বিহীন জীবন যাপন, পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস ইত্যাদি।

এছাড়া অন্যান্য অঙ্গের বিভিন্ন অসুখের কারণেও ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। যেমন অগ্ন্যাশয়ের কোনো অসুখ হলে, যাতে ইনসুলিন তৈরি ব্যহত হয়, তাতে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। আরো কিছু হরমোন আছে, যেমন গ্রোথ হরমোন বা গ্লুকাগন, যেগুলো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কোনো কারণে সেগুলোর পরিমাণ বেড়ে গেলেও গ্লুকোজের বিপাক বাঁধাগ্রস্ত হয়। অন্য রোগের প্রভাবে ডায়াবেটিস হয় বলে এ ধরণের ডায়াবেটিসকে বলে সেকেন্ডারি ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস যে ধরণেরই হোক না কেন, নিয়মিত জীবনাচরণ ও চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সঠিক চিকিৎসায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এজন্যে কেবল প্রয়োজন একটুখানি সচেতনতা ও সদিচ্ছা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart