মেথি বা ঢেঁড়স ভেজানো পানি (Okra water) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কতোখানি কার্যকর?

ডায়াবেটিস মেলাইটাস এমন একটা রোগ যা থেকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া কখনো সম্ভব হয়না। তবে জীবনাচরণের পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবনের মাধ্যমে একে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ রোগে দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খেতে হয় বলে অনেক রোগীই নানা কারণে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে চান না। অনেকেই আবার মনে করেন দীর্ঘ দিন এলোপেথিক ওষুধ খেলে শরীরে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। এসব ধারণা থেকেই অনেকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায়ের খোঁজ করেন। সারা পৃথিবীতেই মানুষ দিন দিন প্রাকৃতিক চিকিৎসার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। যেমন, আমেরিকার কিছু গবেষণায় দেখা যায়, সে দেশের অর্ধেকের বেশি ডায়াবেটিস রোগী সাধারণ ওষুধের পাশাপাশি অলটারনেটিভ মেডিসিন ব্যবহার করেন। আমাদের দেশেও অনেকেই বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ বা অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করে থাকেন।

আজ আমরা মূলত দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, মেথি ও ঢেঁড়স নিয়ে আলোচনা করবো। আর পরে কোনো এক দিন থাকবে গাইনুরা প্রোকামবেনস, যা সাধারণ মানুষের মাঝে ডায়াবেটিস গাছ নামেই বেশি পরিচিত, সেটা নিয়ে আলোচনা। বাঙালি রান্নার অন্যতম উপাদান পাঁচফোড়নের একটা উপকরণ মেথি। মসলা তো বটেই, গ্রাম বাংলায় মেথি শাকও কম জনপ্রিয় নয়। এসব ছাপিয়েও মেথির রয়েছে অনন্য সব ওষুধি গুণ। প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদে নানা রোগের প্রতিষেধক ও পথ্য রূপে এর ব্যবহার চলে আসছে। তবে ইদানিং এটি নতুন করে সামনে এসেছে এর রক্তে শর্করা কমানোর গুণের বদৌলতে। মেথির এ গুণটি প্রথম গবেষকদের নজরে আসে গত শতকের আশির দশকে।

পরবর্তীতে ডায়াবেটিক রোগীদের ওপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, মেথির ব্যবহার ডায়াবেটিক রোগীদের ফাস্টিং ব্লাড গ্লুকোজ, খাবার পরে রক্তের গ্লুকোজ এমনকি HbA1c ও কমাতে সহায়তা করে। সেই সাথে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রাও কিছুটা বাড়াতে সাহায্য করে। মেথিতে থাকে হাইড্রক্সি আইসোলিউসিন নামক একটা এমিনো এসিড, যা অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে ইনসুলিনের ক্ষরণ বাড়ায় ও এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাছাড়া মেথির অন্যান্য উপাদান ক্ষুদ্রান্ত্রে গ্লুকোজের শোষণ কমিয়ে দেয় এবং পেশি কোষে শোষণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়। তাছাড়া এটি ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকিও অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। ডায়াবেটিস ছাড়া রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতেও মেথি ভালো কাজ করে। তবে ঠিক কি পরিমাণ মেথি কীভাবে খেলে তা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে উপকারি, তার সুনির্দিষ্ট মাত্রা এখনো পাওয়া যায়নি। গবেষণায় দৈনিক ১০ গ্রাম থেকে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত মেথি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক একটা গবেষণায় দৈনিক খাবারের সাথে প্রায় ১০ গ্রাম মেথি ব্যবহার করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভালো ফল পাওয়া গেছে।

মেথি মসলা হিসেবে, গরম পানিতে ভিজিয়ে, দুধ বা চায়ের সাথে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে। তবে দৈনন্দিন রান্নায় স্বাদ বাড়াতে যে পরিমাণ মেথি ব্যবহার করা হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই যথেষ্ট। আর আলাদা করে মেথি খেলে তা অবশ্যই ডায়াবেটিস চেক আপের সময় ডাক্তারকে জানাতে হবে এবং তাঁর পরামর্শ মতোই চলতে হবে। মেথির সাধারণত তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে কারো মেথিতে এলার্জি থাকলে এড়িয়ে চলাই ভালো। কিছু গবেষণায় মেথির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা হাত পায়ের স্নায়বিক অনুভূতি কমে যাবার সম্ভাবনার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেহেতু এর নিরাপদ মাত্রা সম্পর্কে খুব বেশি গবেষণা নেই, তাই গর্ভবতী মায়েদের এর অতিরিক্ত ব্যবহার করা উচিৎ নয়। আর যাদের হৃদরোগ আছে বা এন্টিকোয়াগুলেন্ট জাতীয় ওষুধ খান, যেমন ক্লোপিডোগ্রেল বা ওয়ারফেরিন তাঁদের মেথি খাওয়া বারণ। ঢেঁড়স এদেশের বেশ জনপ্রিয় একটা সবজি। অনেকের মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে ঢেঁড়স ডায়াবেটিস কমাতে সহায়তা করে। সত্যি বলতে এ বিষয়ে খুব বেশি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক কালে ইঁদুরের ওপর পরিচালিত কিছু গবেষণায় দেখা যায় রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে এর কিছু ভূমিকা থাকতে পারে। ঢেঁড়স পুষ্টিকর একটা সবজি। এতে থাকে প্রচুর পটাশিয়াম, ভিটামিন বি, সি ও ফলিক এসিডের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। তাছাড়া এতে প্রচুর ফাইবার থাকে। তাই অন্যান্য ফাইবার সমৃদ্ধ সবজির মতো এটিও ক্ষুদ্রান্ত্রে শর্করা শোষণের মাত্রা কমিয়ে দেয়।

তাছাড়া এতে আরো কিছু উপকরণ থাকে, যা রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। তাই দৈনন্দিন খাবারের সাথে ঢেঁড়স রাখা বেশ স্বাস্থ্যসম্মত। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্যে অতিরিক্ত ঢেঁড়স বা ঢেঁড়স ভেজানো পানি খাওয়ার খুব বেশি যৌক্তিকতা এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, বিশেষ করে যাঁরা মেটফরমিন জাতীয় ওষুধ খাচ্ছেন। কেননা কিছু গবেষণায় দেখা যায়, ঢেঁড়স মেটফরমিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে সক্ষম। আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ব্যবহার হয়ে আসছে। এগুলোর রোগ নিরাময় ক্ষমতাও একেবারে কম নয়। তবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের একটা ভুল ধারণা হলো, প্রাকৃতিক বা ভেষজ উদ্ভিদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। মনে রাখতে হবে, ভেষজ হোক বা এলোপেথিক সব ধরণের ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধই সেবন করা উচিৎ না। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য এরকম কোনো ভেষজ বা অন্য কোনো উপকরণ ব্যবহার করে থাকলে তা অবশ্যই চেক আপের সময় চিকিৎসককে জানাতে হবে। কেননা, সে অনুসারে ওষুধের মাত্রা কম বেশি করার প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া আপনার জন্য এগুলোর ব্যবহার কতোখানি নিরাপদ, সেটাও আপনার চিকিৎসকই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart