প্রিডায়াবেটিস: সচেতন হোন শুরু থেকেই

ডায়াবেটিস হবার আগে সাধারণত রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা সাধারণের তুলনায় বেড়ে যায় বা প্রান্তিক সীমায় থাকে। এ অবস্থাকে বলে ইম্পেয়ার্ড গ্লুকোজ টলারেন্স বা অনেক সময় একে প্রিডায়াবেটিস হিসেবেও অভিহিত করা হয়। পুরোপুরি ডায়াবেটিসের মাত্রায় না পৌঁছালেও সঠিক নিয়মে জীবন যাপন না করলে এ অবস্থা থেকে ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি

আমাদের দেশের প্রায় ৩৬ লক্ষ মানুষ প্রিডায়াবেটিস পর্যায়ে রয়েছেন। তবে দুঃখের বিষয়, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশেরও কম মানুষ জানেন যে তাঁরা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন। যদিও বা জানেন, খুব কম সংখ্যক মানুষই নিয়মিত জীবন যাপন করে এ ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করেন। অথচ একটু সদিচ্ছা, জীবন যাত্রার সামান্য পরিবর্তন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আমাদের আজকের আলোচনা সে বিষয়েই।

প্রথমেই বলি, কীভাবে বুঝবেন, আপনার প্রিডায়াবেটিস আছে কিনা? সেজন্যে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করাতে হবে। আমাদের রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা অবস্থায় প্রতি লিটার রক্তে ৬ মিলিমোল বা তার কম এবং খাবার ২ ঘণ্টা পরে ৭.৮ মিলিমোলের কম। যদি প্রতি লিটার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা না খেয়ে থাকা অবস্থায় ৭ মিলিমোল বা তার বেশি এবং খাবার দু ঘণ্টা পর ১১.১ মিলিমোল বা তার বেশি হয়, তখন তাকে ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্বাভাবিক অবস্থা ও ডায়াবেটিসের মাঝামাঝি অবস্থায় থাকলে তাকে বলা হয় ইম্পেয়ার্ড গ্লুকোজ টলারেন্স বা প্রিডায়াবেটিস

প্রিডায়াবেটিস থেকে ডায়াবেটিস হবার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হলো অতিরিক্ত ওজন। আপনার উচ্চতার সাপেক্ষে ওজনের অনুপাত অর্থাৎ BMI যদি ২৫ বা তার বেশি হয়, তাহলে ধরে নেয়া যাবে, আপনি অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী, আর তা যদি ৩০ এর বেশি হয়, তাহলে আপনি স্থূলকায়। কাজেই ওজন মেপে নিন। অতিরিক্ত হলে ঝরিয়ে ফেলুন বাড়তি ওজন। গবেষণা বলছে, প্রতিকেজি ওজন কমালে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে শতকরা ১৬ ভাগ, অর্থাৎ মাত্র ৫ কেজি বাড়তি ওজন কমাতে পারলে আপনার ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি কমে যাবে শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত। ওজন কমানোর জন্যে প্রথমেই যে জিনিসটা দরকারি, সেটা হলো পরিমিত আহার। পরিমিত আহার মানে কিন্তু ডায়েট কন্ট্রোলের নামে অপুষ্টিতে ভোগা নয়।

সব রকমের খাদ্য উপাদান যেন দেহ পায় ঠিক মতো, তাই খেতে হবে নিয়ম মেনে। অতিরিক্ত ক্যালরি ও শর্করাযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে তালিকা থেকে। কোনো শর্করা জাতীয় খাবার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কতখানি বাড়ায়, তার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে দু’ভাগে : হাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স, যেগুলো রক্তে সহজেই গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স, যেগুলো গ্লুকোজের মাত্রা বাড়ায় ধীরে ধীরে। চিকোন সাদা চালের ভাত, ময়দা, কোমল পানীয়, চিনি, গুড় কিংবা নানা পদের মিষ্টান্ন, এগুলো হাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স শর্করা। তাই এগুলো খেতে হবে বুঝে শুনে, পরিমাণমতো। অন্যদিকে লাল ঢেঁকিছাটা চাল, লাল আটা, রঙিন শাক সবজি এগুলো লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এসব থাকা চাই। গরু কিংবা খাসির লাল মাংস রক্তে ক্ষতিকর চর্বির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা কিনা ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ।

অন্যদিকে মাছে থাকে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, এটা শরীরের জন্যে ভালো। তাই নিত্যদিনের লাল মাংস খাবার অভ্যাস ত্যাগ করা উচিৎ। সেই সাথে কমানো উচিৎ ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় খাবার পরিমাণ। কেননা এগুলোর অতিরিক্ত তেল চর্বি ও শর্করা বাড়িয়ে দেয় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। মাছে ভাতে বাঙালি হওয়াটা কেবল ঐতিহ্যগতভাবেই ভালো নয়, স্বাস্থ্যের জন্যেও ভালো। সেই সাথে খেতে হবে প্রচুর শাকসবজি। রঙিন সবজি একদিকে যেমন ভিটামিন ও খনিজ লবণের আধার, তেমনি এগুলো ক্ষুধা মিটিয়ে কমিয়ে দেয় অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণের মাত্রা। গবেষণায় দেখা যায়, টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগী বা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সমস্যা যাদের, তাদের প্রচুর শ্বেতসার আহারের পূর্বে ২ টেবিল চামচ ভিনোগার খেয়ে নিলে রক্তের সুগার কমে আসে। ভিনেগারে রয়েছে এসেটিক এসিড, যা শ্বেতসার পরিপাক করার এনজাইমদের নিষ্ক্রিয় করে ধীরে করে দেয় শ্বেতসার পরিপাক।

রক্তের সুগারের উপর ভিনেগারের প্রভাবটি ডায়াবেটিসের ওষুধ একারবোস এর মতই। আহারে ভাত-মাছ খাওয়ার পূর্বে একপ্লেট সবজি ও স্যালাড, তিন টেবিল চামচ ভিনেগার, টকদই, সামান্য মধু ও গোলমরিচের ড্রেসিং দিয়ে, আপনার রুচিশীলতা বাড়িয়ে দেবে বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে খাবারের পরই আসে ব্যায়ামের কথা। আর হাঁটার চেয়ে সহজ ও ভালো ব্যায়াম আর কী হতে পারে? আমেরিকার একটা গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন মাত্র আধা ঘণ্টা হাঁটা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অর্ধেকে নামিয়ে আনে। ব্যায়াম করলে দেহ কোষের ইনসুলিন রিসেপটারের সংখ্যা বাড়ে। এতে শরীর ইনসুলিন হরমোনকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে।

ইনসুলিন রক্তের সুগারকে কোষের ভেতর ঢুকতে সাহায্য করে, শরীর গ্লুকোজ দহন করে পায় শক্তি ও পুষ্টি। তাই হাঁটা উচিৎ নিয়মিত। প্রতিদিন সকাল বিকাল আধা ঘন্টা করে। শহুরে ব্যস্ত জীবনে অনেকের অভিযোগ, সময় কোথায় হাঁটাহাঁটি করার? অথচ একটু ইচ্ছে থাকলেই কিন্তু সম্ভব। অফিসে কাজে যেতে অল্প দূরত্ব যানবাহন ব্যবহার না করে হেঁটেই যেতে পারেন। কিংবা সময় পেলে সামান্য ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নিতে পারেন। হাঁটা ছাড়াও সাঁতার, সাইকেল চালানো ভালো ব্যায়াম হতে পারে। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানোর একটা ভালো উপায় মানসিক চাপ কমানো।

অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা শরীরের সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে কার্যকর করে। এমন অবস্থায় মস্তিষ্ক রক্তে এমন কিছু হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যেগুলো গ্লুকোজের বিপাক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ে। তাই সবসময় দুশ্চিন্তাকে না বলুন। ইতিবাচক চিন্তা করুন। শিথিলায়ন বা মেডিটেশন করা যেতে পারে। নিয়মিত প্রার্থনা মনকে প্রশান্ত রাখতে সহায়ক। বন্ধের দিন গুলোতে পরিবার পরিজন নিয়ে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন।

নিয়মিত ভালো ঘুম ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। সত্যি বলতে আপনার সামান্য সদিচ্ছা ও নিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণই পারে আপনার ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দিতে। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে দেখে নিন কোন অবস্থায় আছে গ্লুকোজের মাত্রা। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকলে সুস্থ থাকার নিয়মগুলো মেনে চলুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার আজকের সচেতনতাই পারে সারা জীবনের ডায়াবেটিসের ওষুধ খাওয়ার ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দিতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart