মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু

এবছর দেশে আগের বছরগুলোর তুলনায় ভয়াবহ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রধানত দুই ধরণের ডেঙ্গু দেখা যাচ্ছে, সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর আর ডেঙ্গুজনিত রক্তক্ষরণ ও শক সিনড্রোম। সাধারণ ডেঙ্গুর লক্ষণ হলো জ্বর প্রায় ১০৪/১০৫ ডিগ্রি, সাথে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, গিরায় গিরায় ব্যথা। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লাল র‍্যাশ দেখা দেয়। ডেঙ্গুতে রক্তের প্লেটলেট কমে যায়। ফলে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। কাশির সাথে, মলত্যাগের সময় কিংবা দাঁতের গোঁড়া থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

কাজেই এ সময় জ্বর হলে মোটেই হেলা ফেলা করা যাবে না। সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষায় ডেঙ্গু না পাওয়া গেলেও ডাক্তারের পরামর্শমতো চিকিৎসা নিতে হবে। আর চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া জ্বর বা ব্যথা কমানোর জন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। জ্বর কমে গেলেও সাবধান থাকতে হবে। কেননা এ সময়েও শরীরে জীবাণু সংক্রমণের কারণে রক্তের তরল অংশ কমে গিয়ে রোগী শকে চলে যেতে পারেন। হার্ট, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে পড়তে পারে। সাধারণত প্লেটলেট কমে গেলে বা রক্তক্ষরণ হলে রোগীকে রক্ত বা প্লেটলেট দিতে হয়। প্লেটলেট কখন দিতে হবে, সেটা একেক রোগীর ক্ষেত্রে একেক রকম, সেটা চিকিৎসক ঠিক করবেন। আতঙ্কিত হবার প্রয়োজন নেই, আবার হাত গুটিয়ে বসেও থাকা যাবে না।

ডেঙ্গুর কোনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস একটি ভদ্র মশা, অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় এরা বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সাথে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তবে রাত্রে উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা যথাসম্ভব শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখতে হবে, পায়ে মোজ ব্যবহার করা যেতে পারে। বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পড়াতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করতে হবে। দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে। প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্প্রে, লোশন বা ক্রিম, কয়েল, ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, বাড়িঘরে এবং আশপাশে যেকোনো পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি ৩ থেকে ৫ দিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মারা যাবে। পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ঘষে পরিষ্কার করলে ভালো । ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে।

একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকে যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ির ছাদে অনেককে বাগান করতে দেখা যায়, সেখানে টবে বা পাত্রে যেনো জমা পানি ৫ দিনের বেশি না থাকে, সেদিকেও যত্নবান হতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

ঘরের বাইরে মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ার ফলে পানি জমতে পারে। যেমন: ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন/চিপসের প্যাকেটে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে। মশা নিধনের জন্য স্প্রে বা ফগিং করতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনও আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই ডেঙ্গুজ্বর ভবিষ্যতেও থাকবে। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি সম্ভব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart