কীভাবে বুঝবেন আপনার ডায়াবেটিস আছে কিনা?

ডায়াবেটিস এমন একটা রোগ, যাতে নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গ আক্রান্ত হয় না। বরং বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিপাক ক্রিয়ার অসুবিধার সমষ্টিই হলো ডায়াবেটিস। যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গের অসুখ নয়, তাই নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণও প্রকাশ পায় না। মজার বিষয় হলো প্রায় অর্ধেক রোগীর ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের প্রাথমিক অবস্থায় কোনো লক্ষণই থাকে না। অন্য কোনো রোগের চিকিৎসা নিতে এসে বা কোনো রুটিন পরীক্ষার সময় তাঁদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।

অনেকেই মনে করেন, বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়া মানেই ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস হলে ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে, তবে সেটিই একমাত্র লক্ষণ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীদের ত্রিমুখী লক্ষণ প্রকাশ পায়। সেগুলো হলো ঘন ঘন ক্ষুধা পাওয়া, ঘন ঘন তৃষ্ণা পাওয়া এবং ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া। আপনার বা আপনার কাছের কারো যদি এই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়, তবে অবশ্যই দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।

ডায়াবেটিসের আরো একটা লক্ষণ হচ্ছে ওজন কমে যাওয়া। এধরণের রোগীদের প্রচুর খাবার পরেও দিন দিন ওজন কমে যায়। ওজন অবশ্য অনেক কারণেই কমতে পারে। তবে কোনো কারণ ছাড়া ওজন কমতে থাকলে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো উচিৎ। রক্তে গ্লুকোজ বা চিনির পরিমাণ বেড়ে গেলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়, সামান্য কাজ করার পরই দ্রুত ক্লান্তি চলে আসে। বেশি বেশি ঘুম পায়। কাজে মনোযোগ নষ্ট হয়। এছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কমে যায়। রক্তের অতিরিক্ত শর্করা জীবাণুর বংশ বৃদ্ধির জন্যে ভালো কাজ করে। এসময় শরীরে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জনিত বিভিন্ন সংক্রমণ দেখা দেয়। চর্মরোগ বা অন্যান্য ইনফেকশন হতে পারে। এ ধরণের রোগীদের শরীরে কোনো ঘা হলে তা শুকাতে দেরি হয়। 

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুব সচেতন নন। তাঁরা সাধারণত ছোট খাটো সমস্যাগুলোকে পাত্তা দেন না। অথচ সেগুলোই হতে পারে ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণ। যে সময়ে তাঁরা ডাক্তারের কাছে আসেন, তাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। অধিকাংশ রোগীই চিকিৎসার জন্যে আসেন ডায়াবেটিসের নানা ধরণের জটিলতা নিয়ে। প্রাথমিক অবস্থার পরে ডায়াবেটিসের বিভিন্ন জটিল লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। রক্তের অতিরিক্ত চিনি শরীরের বিভিন্ন রক্তনালীতে রক্ত চলাচলে বাঁধার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া ডায়াবেটিস হলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাও বেড়ে যায়। যে কারণে রক্তচাপ বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ব্রেইন স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং হার্ট এটাকের মতো নানা প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি। ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অংশের বিশেষ করে চামড়ার নিচের স্নায়ুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে হাত পায়ে জ্বালা পোড়ার অনুভূতি হয়। অনেক রোগী ডাক্তারের কাছে এসে এমনও বলেন, তাঁরা পায়ের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেন না, পা পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়। অনেক সময় পায়ে বড় কোনো ক্ষত হলেও রোগীরা টের পান না বা ব্যথা অনুভব করেন না। এ সময় পায়ে কোনো ঘা হলে সেটা সহজে শুকায় না। এ অবস্থাকে বলে ডায়াবেটিক ফুট। অনেক সময়ই এ রকম রোগীদের পায়ের কোনো আঙ্গুল এমনকি পুরো পাই কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। রক্তের অতিরিক্ত শর্করা চোখেও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের চোখের জ্যোতি দিন দিন কমে যায়, ঠিকমতো চিকিৎসা না করালে একসময় তাঁরা অন্ধও হয়ে যেতে পারেন।

তবে এগুলো সবই ডায়াবেটিসের শেষ স্তরের জটিলতা। প্রাথমিক অবস্থা থেকেই নিয়মিত চিকিৎসা করালে এসব জটিলতা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। যদি আপনার প্রাথমিক লক্ষণের কোনো একটি প্রকাশ পায়, যেমন ওজন কমে যাওয়া, ঘন ঘন ক্ষুধা বা পিপাসা লাগা বা অতিরিক্ত প্রস্রাব হওয়া, তবে তখনই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এমনকি যদি আপনার এসব লক্ষণ নাও থাকে, তারপরও নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ অনু্যায়ী রক্ত পরীক্ষা করানো উচিৎ। বলা হয়ে থাকে রক্তের যে কোনো পরীক্ষা করাতে গেলেই গ্লুকোজের মাত্রাটা মেপে নেয়া উচিৎ। 

ডায়াবেটিস রোগীদের রক্ত পরীক্ষা মূলত তিন রকমের হয়।  র‍্যান্ডম ব্লাড সুগার বা যে কোনো সময় রক্তের গ্লুকোজ মাপা। এক্ষেত্রে আপনি কখন খেয়েছেন, তা বিবেচনায় নেয়া হয় না। আর একটা পরীক্ষা হলো ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট বা OGTT। এক্ষেত্রে যা করা হয়, সাধারণত ৮ থেকে ১২ ঘন্টা না খেয়ে থাকা অবস্থায় একবার রক্তের গ্লুকোজ মাপা হয়। এরপর রোগীকে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। খাবার ২ ঘণ্টা পরে আবার গ্লুকোজ মাপা হয়। দুই বারেই যদি রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে, তাহলে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে মনে করা হয়। এই পরীক্ষাটা মূলত প্রথমবার ডায়াবেটিস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে করা হয়। এই পরীক্ষাগুলো নিয়ে পরবর্তী কোনো পর্বে বিস্তারিত বলবো।আমাদের রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা কতো, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক কতোটা বাড়লে তাকে ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে ইত্যাদি বিষয় সেখানে আলোচনা করা হবে।

ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের আরো এক ধরণের পরীক্ষা আছে, হিমোগ্লোবিন A1c। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় রোগীর ডায়াবেটিস গত দুই তিন মাসে ঠিক কতোটা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এছাড়া তাকে যে ওষুধ দেয়া হয়েছে, সেটি ঠিক ঠাক কাজ করছে কিনা, ওষুধের ডোজের কোনো কম বেশি করতে হবে কিনা, সেটাও বোঝা যায় এই পরীক্ষার মাধ্যমে। 

সত্যি বলতে ডায়াবেটিস অনেক জটিল রোগ হলেও প্রাথমিক অবস্থায় একে নির্ণয় করতে পারলে চিকিৎসা করাটা অনেক সহজ হয়। তাছাড়া অনেক জটিলতাও এড়ানো যায়। তাই ছোট খাটো শারীরিক সমস্যাগুলোর প্রতিও নজর দিন। হতে পারে, সেটাই আপনার ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণ। আর যে কোনো ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart