ডায়াবেটিস হলে সাধারণত তেমন কোনো শারীরিক লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ফলে রোগটা অনেকের ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে একেবারে হঠাৎ করে, কোনো রুটিন চেক আপের সময়। বিনা মেঘে এমন বজ্রপাতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন অধিকাংশ রোগী। অনেকেই মুষড়ে পড়েন; জীবন নিয়ে হতাশা দেখা দেয়, বিষন্নতা জেঁকে বসে। অথচ ডায়াবেটিস ধরা পড়া মানেই জীবন থেমে যাওয়া নয়। বরং জীবনাচরণের সামান্য পরিবর্তন আর চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে ডায়াবেটিস নিয়েও পরিপূর্ণ জীবনযাপন করা সম্ভব।
প্রথমবারের মতো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি আসলে সাধারণত পুনরায় পরীক্ষা করানো হয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য। যদি ডায়াবেটিস হয়েই যায়, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এসময় সবার আগে যেটা প্রয়োজন, তা হলো নিজের মনোবল ধরে রাখা, আত্মবিশ্বাস ঠিক রাখা। ডায়াবেটিস কোনো পাপের ফল নয়, সুস্থ জীবনের অবসানও নয়। বরং এ সময় জানতে হবে কীভাবে ডায়াবেটিস নিয়েও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করা যায়। আশেপাশের মানুষজন যখন শুনবে আপনার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, দেখবেন, অনেকে ভয় দেখাবে, ভয়ের গল্প শোনাবে যেমন- খালাম্মার পা কেটে ফেলতে হয়েছিলো ডায়াবেটিস রোগের জন্য অথবা কোনো বন্ধুর গল্প যার চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ডায়াবেটিসের কারণে, এমন সব গল্প।
এগুলো আমলে না নেয়াই ভালো। এসব সমস্যা ডায়াবেটিসের জটিলতা বটে, তবে এসব জটিলতা প্রতিরোধ এত সফলভাবে আজকাল করা সম্ভব যে এমন পরিনতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম যদি একটু সচেতন ও সতর্ক হওয়া যায়। ডায়াবেটিক চিকিৎসক বা ডায়াবেটিস এডুকেটর রোগ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেন রোগীকে। জীবন-যাপনে পরিবর্তন আনার জন্য ও প্রয়োজনে ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। তাই রোগ নির্ণয়ের সাথে সাথেই চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন। সম্ভব হলে ডায়াবেটিস নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া ভালো। এদেশে ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি’ সহ বেশ কিছু সংগঠন আছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বিশেষায়িত হাসপাতালও রয়েছে, যেখানে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সেবা এক ছাদের নিচেই পাওয়া যায়। তাছাড়া রোগীদের জন্যে তাদের লিফলেট, বুকলেটসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামও রয়েছে।
প্রথমবার ডায়াবেটিস ধরা পড়লে শুরুতেই ওষুধ নাও লাগতে পারে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন করেই এসময় অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এজন্যে প্রথমেই প্রয়োজন অতিরিক্ত ওজন থাকলে তা কমিয়ে ফেলা। তবে এখানে বলে রাখা ভালো অনেকেই মনে করেন ওজন বেশি হলেই কেবল ডায়াবেটিস হয়। বিষয়টা এতোটা সরল নয়। অতিরিক্ত ওজন ডায়াবেটিসের একটা রিস্ক ফ্যাক্টর মাত্র। অনেক হালকা পাতলা মানুষেরও ডায়াবেটিস হতে পারে। বংশগতি একটা বড় প্রভাবক এক্ষেত্রে। যাই হোক, ডায়াবেটিস হলে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও শারীরিক পরিশ্রমের বিকল্প নেই। শরীরচর্চাকে একটু বাড়ানো তেমন কঠিন কাজ নয়। এতে রক্তের সুগার কমে দু’টি কারণে। ব্যায়াম করলে শরীর ইনসুলিন আরো কার্যকর ভাবে ব্যবহার করতে পারে, তাছাড়া শরীরের বাড়তি ওজনও কমে। একটু বেশি হাঁটুন।
অল্প অল্প করে শুরু হোক। ব্যায়াম যেন বোঝা মনে না হয়, বরং সেটা হোক নিত্যদিনের কাজেরই অংশ। যেমন- উচু বিল্ডিং-এ উঠতে হলে লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, গাড়ি দূরে পার্ক করে হেঁটে যান গন্তব্যে, এক স্টপ আগে বাস থেকে নেমে পড়ুন, এরপর হেঁটে যান। ক্রমে ক্রমে প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে হাঁটুন। টাইপ-২ ডায়াবেটিস যাঁদের, তাঁদের জন্য নিয়মিত ফিটনেস রুটিন অনুসরণ করলে রক্তের গ্লুকোজ কমাবার ওষুধের চাহিদা অনেক কমে আসবে। খাদ্যাভ্যাসে চাই পরিবর্তন। হঠাৎ করে বড় পরিবর্তন কষ্টকর। তাই একসঙ্গে একটি খাদ্যের পরিবর্তন লক্ষ্য হতে পারে। এতে লেগে থাকতে হবে। যেমন- মাঝারি সাইজের খাবার প্লেটের অর্ধেকটা ভরে ফেলুন শর্করা বিহীন টাটকা রঙিন শাক সবজি দিয়ে। বাকি অর্ধেকের অর্ধেকে নিন গোটাশস্য, সাদা চিকন চালের বদলে লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি। প্লেটের বাকিটায় মাছ মাংস। তবে পারতপক্ষে লাল মাংস পরিহার করাই ভালো। মাছ হজম হয় দ্রুত, এর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়ক।
প্রতি বেলার খাবারে থাকুক এমন পরিবর্তনের ছোঁয়া। এমন খাবার খান যাতে ক্যালোরি কম, শর্করা কম, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও ফাইবার পরিপূর্ণ। রক্তের গ্লুকোজ, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা করতে হবে নিয়মিত। রক্তের গ্লুকোজের মাত্রাভেদে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ডায়াবেটিস হলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে দ্বিগুন। এর পেছনে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের অবদান কম নয়। রক্তচাপ ১৩০/৮০ বা তার নিচে হলে ভালো, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিএল ১০০ এর নিচে হলে এবং হিতকর কোলেস্টেরল এইচডিএল ৪০ এর বেশি হলে ভালো। নিয়মিত ত্বক, পা ও চোখের অবস্থা পরীক্ষা করা উচিৎ। ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ু বা রক্তনালীর ক্ষতি হলে অঙ্গে রক্ত চলাচল কমে যায়। সহজে ঘা শুকাতে চায় না। পায়ে ফোসকা বা ক্ষত হতে পারে, এগুলো চিকিৎসা না করালে সংক্রমণ হতে পারে। গুরুতর হলে অঙ্গহানিও হতে পারে।
তাছাড়া এ সময় চোখের জ্যোতিও কমে যেতে পারে ধীরে ধীরে। প্রতিদিন তাই নজর করা উচিত। পা ঝিন ঝিন করলে, অবশ মনে হলে, কোনো ঘা হলে, চোখে দেখতে কোনো অসুবিধা হলে ডাক্তার দেখানো উচিত। সফলভাবে ডায়াবেটিস মোকাবেলা করতে দলবদ্ধভাবে চেষ্টা করুন। আশেপাশের ডায়াবেটিস রোগী ও স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের নিয়ে তৈরি করতে পারেন ডায়াবেটিস সাপোর্ট গ্রুপ। পরিবারের সবাইকে, বন্ধু-বান্ধবকে, ডায়াবেটিস হলে সাহায্য চাইতে বলুন, ডাক্তারদের, ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞদের। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবকে আনুন ডায়াবেটিস এডুকেশন ক্লাসে, হাঁটার প্রোগ্রামে যোদ দিতে বলুন। খাদ্যে ও লাইফস্টাইলে যেসব পরিবর্তন যা যা প্রয়োজন তা প্রিয়জনদেরকে জানালে সুবিধা হয়। কেবল ডায়াবেটিস রোগীদেরই নয়, সকল সচেতন মানুষের উচিৎ স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়া। স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন কেবল ডায়াবেটিস নয়, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোকের মতো জীবনঘাতী রোগের ঝুঁকিও কমায়।