ডায়বেটিস- খাবার এবং এর বৃত্তান্ত (২)

অনেক সময়ই দেখা যায়, ডায়াবেটিস রোগীরা কোন ধরণের খাবার কতোটুকু খাবেন সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। এই পর্বে আমরা মূলত এই বিষয়টি নিয়েই কথা বলবো। প্রতিদিনের স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবারের তালিকা তৈরিতে পাঁচটি খাদ্য উপাদানের প্রতি অবশ্যই নজর দিতে হবে। সেগুলো হলো শস্যজাতীয় খাদ্য, মাছ মাংস, সবজি, ফলমূল ও দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার। প্রতিবেলার খাবারে এসব আইটেমের কোনটা কতোটুকু থাকবে, তার হিসেবটা বুঝে নেওয়াও জরুরি। এ বিষয়ে আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন এর ‘হেলদি প্লেট’ কনসেপ্ট বেশ কার্যকর। এখানে বলা হয়, খাবার খেতে হবে মাঝারি সাইজের বা প্রায় ৯ ইঞ্চি মাপের প্লেটে।

শুরুতেই প্লেটকে চার ভাগে ভাগ করে তার দুই ভাগে নিতে হবে শাকসবজি ও ফলমূল। বাকি দুই ভাগের এক ভাগে থাকবে মাছ মাংস বা আমিষ জাতীয় খাবার। আর বাকি এক ভাগ পূরণ করতে হবে শর্করা জাতীয় খাবার দিয়ে। আরেকটি গাইড লাইন আছে ‘কানাডিয়ান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনে’র। তারা বলছে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণে আপনার হাতই রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুরুতেই আপনার দুহাতে যে পরিমাণ শাক সবজি ধরে নিয়ে নিন পাতে। এরপর হাত মুঠো করুন। ঠিক ওই মুঠোর সমপরিমাণ শর্করা পাতে নিন।

আমিষ জাতীয় খাবার বা মাছ মাংসের টুকরার সাইজ হবে আপনার হাতের তালুর সমান। সেই সাথে এক কাপ লো ফ্যাট দুধ ও মুঠো পরিমাণ ফল। এইতো বেশ স্বাস্থ্যকর আহার। অবশ্য এভাবে মেপে খাবার অভ্যেসটা ঠিক বাঙালিয়ানার সাথে যায় না। আমরা চিরকালই মাছে ভাতে বাঙালি, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, সাথে ভাজা ইলিশ কিংবা গরুর ভুনা, ও-ই আমাদের কাছে বেশি লোভনীয়। ভাতের চেয়ে বেশি তো দূর, সবজিই অনেকের পছন্দ নয়। এমন অভ্যেস থাকলে সেটা ছেড়ে দেয়াটা জরুরি। স্বাস্থ্যকর আহারের অভ্যেসটা দৈনন্দিন জীবনাচরণের সাথে মিলয়ে নিতে হবে। তাহলেই আর কষ্টকর মনে হবে না। পরিবারের অন্য সবাই সাত পদে রসনা বিলাস করবে, আর ডায়াবেটিস রোগীর জন্যে কেবল মাপা খাবার, বিষয়টা দৃষ্টিকটু।

পরিবারের সবার জন্যে এক মেনুতেই রান্না হোক। কেননা, স্বাস্থ্যকর খাবার কেবল ডায়াবেটিস রোগীর জন্যে নয়, বরং সবার জন্যেই জরুরি। ডায়াবেটিস রোগীদের খাবার খেতে হবে নিয়ম মেনে। পরিবর্তন সামান্য হোক, তবে তা যেন নিয়ম মাফিক ও ধারাবাহিক হয়। দীর্ঘদিনের ভাত খাবার অভ্যাসটা হয়তো এক দিনেই পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব না, তবে ধীরে ধীরে অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। একদিন ডায়েট কন্ট্রোল করে পর দিন প্রচুর খেলে সেটা খুব বেশি কাজে আসবে না। সকাল, দুপুর, রাত এই তিন বেলা প্রধান খাবার, আর এর মাঝে দু বার নাস্তা। দুটো খাবারের সময়ের ব্যবধান ৬ ঘণ্টার বেশি হওয়া উচিৎ নয়। বাজার করা থেকে খাবারের টেবিল সব ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি।

বাজারে যাবার আগেই খাবারের মেনু ঠিক করুন। সে অনু্যায়ী বাজারের লিস্ট করুন এবং সে অনুসারেই কেনাকাটা করুন। বাজারে গিয়ে অস্বাস্থ্যকর বা মুখরোচক কিছু দেখলেই কিনে ফেলার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখুন। এতে করে একদিকে যেমন টাকার অপচয় কম হবে, তেমনি স্বাস্থ্যকর খাবার অভ্যাসটাও গড়ে উঠবে। কাঁচা বাজারে টাটকা সবজি ও ফল কিনতে চেষ্টা করুন। গ্রোসারি বা সুপারশপ থেকে বাজার করার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রসেসড ফুড বা সুগার কর্নার এড়িয়ে চলুন।

রান্নায় অতিরিক্ত তেল, বাটার, ঘি ব্যবহার না করাই ভালো। সম্ভব হলে পরিবারের সবাই একসাথে খান, অন্তত এক বেলা। খাবারের প্রতিটি গ্রাস উপভোগ করুন। সম্ভব হলে প্রতিবেলা খাবারের পর নোট রাখুন, কতো ক্যালরি খেলেন, কতোটা শর্করা কমলো। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ফুড ডায়েরি পাওয়া যায়, ডাউনলোড করে নিতে পারেন। সপ্তাহ শেষে পরিবর্তনটা নিজের চোখেই ধরা পড়বে। খাবারের তালিকা নিয়ে অনেকের মধ্যেই কিছু ভুল ধারণা আছে। অনেকেই মনে করেন মাটির নিচের খাবার বোধ হয় খাওয়া উচিৎ না। কথাটা ঠিক নয়। খাবার মাটির নিচে হোক বা ওপরে, তার পুষ্টিমান অনুসারেই খাওয়া উচিৎ।

শর্করার পরিমাণ কমাতে ভাত বা রুটির ওপর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সেই সাথে কিছু মিষ্টি ফল যেমন আম, কলা, পেঁপে আঙ্গুর এগুলোও খুব দ্রুত রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়। তাই নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি খাওয়া উচিৎ নয়। ফাইবার সমৃদ্ধ ও লো ক্যালরি সবজি যেমন বিভিন্ন শাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, উচ্ছে, করলা বা বেগুন ইত্যাদি নিয়মিত খাওয়া উচিৎ। প্রতিবেলার খাবারে যেন সকল উপাদান সুষমভাবে থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। সকালের নাস্তাটা খুব জরুরি। প্রবাদ আছে, ‘Take your breakfast like a king, lunch like a priche and dinner like a beggar.’ অথচ আমাদের দেশে অনেকটাই উল্টো চল।

যাই হোক সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যেই নাস্তা সেরে ফেলা ভালো। সেটাই আপনার সারা দিনের কর্মশক্তির একটা বড় অংশের জোগান দেবে। নাস্তায় খাওয়া যায় ১২০ গ্রাম বা তিন চারটি মাঝারি সাইজের লাল আটার রুটি, একটা ডিম, সবজি আর এক গ্লাস দুধ। কিংবা বিলেতি স্টাইলে ব্রেড, ২ চামচ জেলি, ডিম, একটা ফল, এক কাপ দুধ, চিনি ছাড়া চা বা কফি। যাই খাওয়া হোক, ক্যালরি আর শর্করার ব্যালান্সটা যেন ঠিক থাকে। দুপুরে সাধারণত বাঙালি রোগীদের ভাতই খেতে বলা হয়। তবে লাল চাল হলে ভালো। মাঝারি ১ প্লেট (৩৬০ গ্রাম) ভাত, মাঝারি সাইজের (৬০ গ্রাম) মাছ/ মাংসের টুকরো, দেড় কাপ ডাল আর প্রচুর শাক সবজি।

আর রাতে ভাতের বদলে আটার রুটি, সবজি, মাছ কিংবা মাংস। সঙ্গে এক কাপ দুধ আর একটা ফল রাখা যায়। প্রধান খাবারের মাঝে সকাল বিকাল স্ন্যাকস রাখতে হবে। ৩০ গ্রাম শর্করাযুক্ত বিস্কুট বা মুড়ি বা অন্য কিছু, সাথে একটা ফল। তবে নিত্য দিন এমন একঘেঁয়ে খাবারে মন চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক। সপ্তাহে বা মাসে দু একবার একটু ভালো মন্দ খাওয়াই যায়। বাসায় কিংবা পরিবারের সবার সাথে রেস্টুরেন্টে। এক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ থিওরি বেশ কার্যকর। মানে হলো আপনি যাই খান, আপনার মোট ক্যালরি ও শর্করার পরিমাণ যেন একই থাকে। যেমন ভাতের চেয়ে পোলাও বা বিরিয়ানিতে ক্যালরির পরিমাণ বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে এক প্লেট ভাতের বদলে হাফ প্লেট বিরিয়ানিই যথেষ্ট।

মিষ্টান্ন খেলে অন্য শর্করা বাদ দিন। ডায়াবেটিস রোগীরা কী ধরণের খাবার খেতে পারবেন সেটা তাঁর শরীর ও রোগের অবস্থার ওপরে অনেকটাই নির্ভর করে। এজন্যে সামগ্রিক ডায়েট প্ল্যান বলে কিছু নেই। আপনার চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদই সঠিক ডায়েট প্ল্যান দিতে পারবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart