ঋতু পরিবর্তনের সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়

অনেক ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁরা শৃঙ্খলা পূর্ণ জীবন যাপন ও নিয়মিত ওষুধ বা ইনসুলিন ব্যবহার করার পরও অনেক সময় ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। সত্যি বলতে ডায়াবেটিস বা রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্যে শারীরিক পরিশ্রম বা ওষুধই একমাত্র নিয়ামক নয়, এখানে নানা ধরণের পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত প্রভাবও কাজ করে।

বিশ্বব্যাপী পরিচালিত বেশ কিছু গবেষণায় দেখা যায়, গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীত বা বসন্ত কালে রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের পরেও রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি পাওয়া যায়। এর সঠিক কারণটা এখনো স্পষ্ট না, তবে ধারণা করা হয়, শীতকালে রোগীদের ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রমের প্রতি উদাসীনতা এর পেছনে দায়ী থাকতে পারে। এছাড়া উৎসব পার্বনের নানা পদের খাবার দাবারের লোভ সামলাতে না পারাটাও একটা বড় কারণ। আজ আমরা মূলত এ বিষয়টা নিয়েই আলোচনা করবো।

শীতে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে যে কাজটা সবচেয়ে কষ্টকর, সেটা হলো প্রতিদিন সকাল সকাল হাঁটতে বের হওয়া। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে কম্বলের ওম ছেড়ে কে-ই বা আর বেরোতে চায়? কিন্তু বেরোতেই হবে, কেননা এই সামান্য ত্যাগটুকুই আপনার রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। সামনের দিনের বড় জটিলতা থেকে বাঁচিয়ে দেবে। খুব সকালে না গিয়ে একটু বেলা করে হাঁটতে যেতে পারেন; সকালের হালকা মিষ্টি রোদে আপনার দেহের সাথে মনও হয়ে উঠবে চনমনে। তাও না পারলে বিকেলে হাঁটতে পারেন। কিংবা দিনের অন্য কোনো সময়, যখন আপনার সুবিধা হয়। তবে একদম খালি পেটে বা ভরা পেটে ব্যায়াম করা উচিৎ নয়। সকালে হাঁটতে গেলে হালকা নাস্তা করে যান। চিনি ছাড়া বিস্কুট বা সিরিয়াল। বার্লি বা আমাদের দেশি মুড়িও রক্তে গ্লুকোজ বাড়ায় না। চিনি ছাড়া এক কাপ চা খেতে পারেন। আদা দিয়ে। আদা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো, শর্করার বিপাকেও ভালো কাজ করে। তবে কফি খাওয়া ত্যাগ করাটাই ভালো। যদিও কিছু গবেষণা বলছে কফি ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি কমায়, কিন্তু ডায়াবেটিস হয়ে যাবার পর সেটা উল্টো কাজ করে, মানে কফি বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন রক্তে গ্লুকোজ বিপাকের হার কমিয়ে দেয় ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দেয়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বিষয়ে আমরা অন্য একটা পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

ডায়াবেটিস রোগীদের একটা বড় অংশই বয়স্ক রোগী। ডায়াবেটিস ছাড়াও তাঁদের নানা ধরণের অসুখ থাকে। যেমন শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, উচ্চরক্তচাপ, হার্টের অসুখ ইত্যাদি। যাঁদের হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট আছে, এসময়টায় তাঁদের আরো সাবধান হতে হবে কেননা, শীতের কুয়াশা, ধুলাবালি বা বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের রেণু শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই সকালে হাঁটতে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা উচিৎ। তাছাড়া ঠাণ্ডা জনিত অসুখ থেকে বাঁচতে আরামদায়ক শীতের কাপড় পরা জরুরী, যা কিনা শরীরকে বাঁচাবে ঠান্ডা থেকে, আবার হাঁটতেও অসুবিধা সৃষ্টি করবে না। হালকা উলের সোয়েটার বা ট্রাক স্যুট ব্যবহার করতে পারেন। এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পায়ের যত্ন নেয়া। পা কখনোই খোলা রাখা উচিৎ না, বিশেষ করে কোথাও বেরোনোর সময়। আরামদায়ক মোজা ব্যবহার করুন। বাটা, এপেক্সসহ সব ধরণের জুতার দোকানে ডায়াবেটিস কর্নার থাকে। সেখানে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে বিশেষভাবে ডিজাইন করা জুতা পাওয়া যায়। সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। আপনার সামান্য অসাবধানতা আপনার পায়ের বড় ক্ষতি করতে পারে। কেননা ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের স্নায়ুগুলো অনেক সময়ই অসার হয়ে পড়ে, ফলে ব্যথা পেলেও টের পাওয়া যায় না। অনেক সময় ঠাণ্ডায় পায়ে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। পায়ের আঙ্গুলে এরকম সমস্যা বেশি হয়। সামান্য আঘাত থেকে অনেক বড় সংক্রমণের আশংকা থাকে, কেননা এ সময় ঘা সহজে শুকায় না। তাই পায়ের প্রতি অবহেলা নয়।

শীতে ডায়াবেটিস বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত আহার। এ সময় চারপাশে উৎসব পার্বনের ধুম পড়ে। খেজুর গুড়ের পিঠা পায়েস থেকে বড় দিন কিংবা বর্ষবরণের কেক, সবই রক্তে শর্করা বাড়ানোর নিয়ামক। তাই এ সময় খেতে হবে একটু রয়ে সয়ে। নতুন খেজুর গুড়ের ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা কিংবা মিষ্টি রসে ডুবানো চিতই পিঠার লোভটা সামলে চলতে হবে। বাদ দিতে হবে চিনি আর ক্যারামেল ক্রিমে ভরপুর বর্ষ বরণের কেকটাও। কেননা, এসব খাবার যতো মুখরোচকই হোক না কেন, স্বাস্থ্যগত দিক থেকে উপাদেয় নয় মোটেও। তার বদলে নজর দিন সবজি বাজারের দিকে। বছরের এ সময়টায় রং বেরং এর নানা রকম সবজি পাওয়া যায়। এগুলো একদিকে যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিকর। তাই প্রতিবেলার খাবারে সবজি থাকা চাই। এখানে বলে রাখা ভালো, অনেকের মধ্যেই একটা ভুল ধারণা আছে, মাটির নিচের সবজি রক্তের শর্করা বাড়ায়। কথাটা মোটেও ঠিক না। সব মাটির নিচের সবজি শর্করা বাড়ায় না। বরং গাজর, রসুন, আদা এগুলো শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। তাছাটা পালং শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকোলি, টমেটো এগুলোও সহজে রক্তে গ্লুকোজ বাড়ায় না। তাই এগুলো খাওয়া যাবে ইচ্ছে মতো। রান্না করা সবজির পাশাপাশি পাতে থাকুক সালাদ। খাবার টেবিলে জুলিয়ান কাটের রঙিন সবজি আর তার সাথে টকদই, ভিনেগার আর সামান্য গোলমরিচ গুঁড়ার ড্রেসিং, একদিকে যেমন রুচিশীলতার পরিচায়ক, তেমনি উপাদেয় ও স্বাস্থ্যকর। সেই সাথে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক। এসময় চারপাশে উৎসব পার্বনের আধিক্য দেখা যায়। তাই কেবল বাড়িতেই নয়, কোনো দাওয়াতে গেলেও খাবারের প্রতি নজর দিন। পোলাও বা কাচ্চি বিরিয়ানি বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করে নিন সাদা ভাত বা স্টিমড রাইসের ব্যবস্থা আছে কিনা। গরু কিংবা খাসির মাংস খান বুঝে শুনে, পরিমাণমতো। তার বদলে সবজির পদে নজর দিন। একদম পেট পুরে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। বুফের ক্ষেত্রেও একই কথা। মাটন বা ডেজার্ট আইটেম থেকে নজর সরিয়ে স্যুপ, সালাদ, সবজির আইটেম পাতে নিন। প্রথম প্রথম হয়তো একটু কষ্টকর, কিন্তু ক’দিনেই অভ্যাস হয়ে যাবে। তখন কাচ্চি নয়, বরং সবজি আর মাছের ঝোলকেই আপন মনে হবে।

এই শীতে আপনার সামান্য সদিচ্ছা আর নিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণই পারে আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ মতো নিয়মিত চেক আপ ও ওষুধ বা ইনসুলিন ব্যবহারের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের দিকেও নজর দিন।

Reference :

১. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/m/pubmed/19535310/

২. https://professional.diabetes.org/abstract/seasonal-variation-hemoglobin-a1c-individuals-diabetes

৩. https://www.diabetes.co.uk/natural-therapies/ginger.html

৪. https://www.healthline.com/health/coffee-s-effect-diabetes

৫. https://www.livestrong.com/article/319983-vegetables-that-could-lower-blood-pressure-sugar-levels/

৬. https://www.everydayhealth.com/type-2-diabetes/diet/low-carb-veggies-for-diabetic-diets/

৭. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5954571/

৮. https://www.healthline.com/health/diabetes-and-yogurt

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart